গোস্ট অফ কেটু!! পৃথিবীর সবথেকে রহস্যময় ভুতূরে পর্বতশৃঙ্গ 😮😲


 কেটু হচ্ছে পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তানে অবস্থিত পৃথিবীর ২য় সর্বোচ্চতম শৃঙ্গ। এভারেস্টের চেয়ে এই পর্বতটি সামান্য একটু নিচু। ২০০৮ সালের আগস্টে এই পর্বতেই ঘটে যায় রহস্যময় এক ঘটনা। যার রহস্য আজও জানা যায়নি।


কেটু বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম পর্বতগুলোর একটি। এটি আরোহন করতে যাওয়া প্রতি ১০০ জনের ভেতর ৩০ জনই মারা যায়। অত্যন্ত খাড়া আকৃতির কারনে কেটু আরোহন করা এভারেস্টের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন। তাই এভারেস্ট বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ হলেও কেটু ক্লাইম্বিং এর ডিমান্ড এভারেস্টের চেয়েও অনেক বেশি। এই কারনে কিং অফ মাউন্টেনস খেতাবটি এভারেস্টকে বাদ দিয়ে কেটুর ভাগ্যে জুটেছে।


২০০৮ সালে হল্যেন্ড, কোরিয়া, সার্বিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ইতালি এই ৬ দেশের মোট ৬ টি ক্লাইম্বিং গ্রুপ এক সাথে কেটু আরোহনের সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রুপ গুলোতে উক্ত ছয় দেশের ক্লাইম্বাররা ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তান, নরওয়ে এবং আয়ারল্যান্ডের ক্লাইম্বার সহ মোট ৩০ জন পর্বতারোহী ছিলো। প্ল্যানিং অনুজায়ী জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে তারা কেটুর পাদদেশে এসে পৌছায়।  


আগস্টের ১ তারিখ ৩০ জন পর্বতারোহীর দলটি কেটুর শিখরে পৌছানোর লক্ষে ক্লাইম্বিং শুরু করে। দলটির লিডার ছিলেন ভেন রিজেল নামের অত্যন্ত অভিজ্ঞ একজন ক্লাইম্বার, যিনি ইতিপূর্বে এভারেস্ট সহ আরো বেশকিছু শৃঙ্গ জয় করেছেন।


কিন্তু আরোহন শুরু হবার মাত্র ১২ ঘন্টার মাথায় শুরু হয় বিপত্তি। ড্রেন মেন্ডিক নামক একজন ক্লাইম্বার দ্রুত আরোহনের জন্য লাইফ রোপ থেকে নিজেকে খুলে নিয়ে দ্রুত উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। আর কিছুক্ষনের ভেতরেই স্লিপ করে কেটুর প্রথম শিকারে পরিনত হয় সে। ঘন্টা খানেকের মাথায় তার বডি উদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যায় আরেক পাকিস্তানি ক্লাইম্বার। 


এমন পরিস্থিতিতে সিলিয়েস স্কর্গ নামের নরওয়ের এক মহিলা ক্লাইম্বার সহ আরো কয়েকজন পর্বতআরোহী ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। সিলিয়েস স্কর্গ তার স্বামী রালফ বে এর সাথে কেটু আরোহন করতে এসেছিলো। মাত্র ১ মাস আগে বিয়ে হয়েছে তাদের। রালফ তখন এমন কেটুর একটা প্রান্ত অতিক্রম করছিলো যেখানে পর্বতের গায়ে বিশালাকার তুষার খন্ড জমে রয়েছিলো। দূর্ভাগ্যবসত ঠিক সেই সময়ই বরফ খন্ড গুলোতে ধস শুরু হয়। সেই ধসের নিচে চাপা পরে সিলিয়েস স্কর্গের চোঁখের সামনেই মারা যায় তার স্বামী। এতক্ষন পর্যন্ত যা ঘটেছে তাকে নিতান্ত দুর্ঘটনা বলা যায়৷ কিন্তু এরপর শুরু হয় ব্যাখ্যাহীন কর্মকান্ড। 


৫ই আগস্ট সন্ধা ৭ টার সময় গ্রুপ লিডার ভেন রিজেল এবং কয়েকজন আরোহী মাউন্ট কেটুর শিখরে পদার্পন করতে সক্ষম হয়। সন্ধার গোধূলির আলোয় মেঘ ফুড়ে উপরে উঠা কেটুর শিখর থেকে চারপাশকে অপার্থিব সুন্দর লাগছিলো। মেঘের কারনে উপর থেকে কেটুর পাদদেশ দেখা যাচ্ছিলো না।


কেটুর উচ্চতা ৮ হাজার ৬১১ মিটার। আর ৮ হাজার মিটারের অধিক উচ্চতাকে বলা হয় ডেথ জোন। এই উচ্চতায় পৌছালে মানব দেহের স্বাভাবিক ক্রিয়া-কলাপ বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। পর্যাপ্ত খাবার, অক্সিজেন থাকলেও এই উচ্চতায় মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এত উচ্চতায় রাত কাটনো কোনো ভাবেই সম্ভব নয় বিধায় ভেন রিজেল সিদ্ধান্ত নেয় রাতের মাঝেই ডেথ জোন লেভেলের নিচে পৌছাতে হবে। ফলে তারা নিচে নামতে শুরু করে। 


খানিকটা নামার পর তারা অনেকটা নিচ থেকে কয়েকটি টর্চের আলো দেখতে পায়। টর্চগুলো উপরের দিকে তাক করা অবস্থায় জ্বলছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই সবগুলো টর্চ এক সাথে বন্ধ হয়ে যায়।


নামতে নামতে তারা সেই স্থানে এসে পৌছায়, যেখান থেকে টর্চগুলো জ্বলছিলো। সেখানে এসে দেখা গেলো তিন জন কোরিয়ান ক্লাইম্বারের লাশ পরে রয়েছে। তুষার ধসের কোনো চিহ্নও নেই, তারা কিভাবে মারা গিয়েছে বোঝা গেলো না।


একই সময় কেটুর অপর এক পাশে রহস্যজনক ভাবে মারা যায় আরো ২ নেপালি ক্লাইম্বার। এদিকে হঠাৎ করে অদ্ভুত এক কান্ড ঘটে। ম্যাকডন্যাল নামের একজন পর্বতারোহী কাউকে কিছু না বলেই নিচে নামা বাদ দিয়ে উল্টো উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। পরবর্তিতে সে আর কখনো নিচে ফিরে আসেনি।


এদিকে ফ্রস্ট বাইটের কবলে পরে গ্রুপ লিডার ভেন রিজেল প্রায় অন্ধের মত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সে ক্লাইম্বিং বন্ধ করে কেটুর বুকে শুয়ে পরে। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছিলো কেটুর সাথে সে আর পেরে উঠবে না। ভেন রিজেলের সঙ্গিরা তাকে সেভাবে রেখেই নিচে নামতে শুরু করে। 


এদিকে পর্বতারোহীদের এই পরিনতির খবর পৌছে যায় পাকিস্তান আর্মির কাছে। রেসকিউ মিশনের জন্য হেলিকপ্টার পাঠায় তারা। তবে পাকিস্তান আর্মিও পরে বিপত্তির মুখে। কারন উক্ত অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার মিটার উচু। এই অল্টিটিউডে বাতাস খুবই পাতলা হওয়ায় হেলিকপ্টার সেখানে উড়তে পারেনা। তবু বহু প্রচেষ্টার পর হেলিকপ্টার কেটুর পাদদেশে পৌছাতে সক্ষম হয়। কেটু থেকে নেমে আসা জীবিত ক্লাইম্বারদেরকে হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তানের স্কার্দু হাসপাতালে নিয়ে যায় পাক আর্মি।


সেই ভয়ংকর ক্লাইম্বিয়ে ৩০ জন পর্বতারোহীর মাঝে ১১ জনই মারা যায়। বেঁচে থাকা ১৯ জনের ভেতর মাত্র ২-৩ জন কেটুর চুড়ায় পদার্পনের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলো, বাকিরা ক্লাইম্বিংয়ের মাঝ পথেই বেইস ক্যাম্পে ফিরে এসেছিলো। তারাও ফ্রস্ট বাইটের কবলে পরে মারাত্বক রকমের আহত হয়। 


এই ঘটনা বিশ্বব্যপি ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। টিভি রিপোর্টের পাশাপাশি এই ঘটনার উপর বেশ কিছু বই রচনার এবং অনেক ডকুমেন্টারিও নির্মিত হয়। সেই সাথে ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ক্লাইম্বিং হিসেবে নথিভুক্ত হয় ইতিহাসের পাতায়।


কেটুতে নিহত পর্বতারোহীদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়না। আর পেলেও তা নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হয়না। তাই নিহতদেরকে স্মরণের জন্য কেটুর পাদদেশে তাদের নাম খোদাই করে রাখা হয়৷ এপর্যন্ত ৯০+ জনের নাম খোদাই করা হয়েছে সেখানে। নিহত এসব ব্যাক্তিদেরকে বলা হয় "গোস্ট অফ কেটু"। অনেকের বিশ্বাস করে নিহতদের আত্নার সাথে কেটুর এসব ঘটনার কোনো যোগসুত্র আছে। আজও যেকোনো পর্বতারোহীর জন্যই কেটু জয়ের স্বপ্ন এক বিভীষিকার মত।


রিপোর্ট: শেখ সাইদুর ইসলাম।

Comments

Popular posts from this blog

কক্সবাজার সেন্টমার্টিন বাজেট ট্যুর।

কে এই ড.জাফর উল্লাহ? আসুন কিছু তথ্য ড. জাফরুল্লাহ সম্পর্কে একটু জেনে নিই।